বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পটভূমি ও বিজয়

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। এই যুদ্ধটি ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত চলে এবং এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।



বাংলাদেশ, যা তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের অবহেলা, অর্থনৈতিক বঞ্চনা, এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নের শিকার ছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।

সূচিপত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পটভূমি ও বিজয়

যুদ্ধের শুরু হয়ঃ

২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে অপারেশন সার্চলাইট নামক একটি সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি নিহত হন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধাপসমূহঃ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রধানত তিনটি ধাপে বিভক্ত ছিল, যা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিটি ধাপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং ঘটনা উল্লেখযোগ্য। নিচে মুক্তিযুদ্ধের ধাপসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো:

প্রথম ধাপ: গণহত্যা ও প্রতিরোধ (মার্চ - মে)

মার্চ ২৬, ১৯৭১ঃ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরু করে, যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের একটি নৃশংস সামরিক অভিযান। এই অভিযানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়।


মার্চ - মেঃ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান শহরগুলোতে দখল প্রতিষ্ঠা করে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে। মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করে।


প্রতিরোধ গঠনঃ বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

দ্বিতীয় ধাপ: গেরিলা যুদ্ধ ও মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা (জুন - আগস্ট)

গেরিলা যুদ্ধঃ মুক্তিযোদ্ধারা (মুক্তিবাহিনী) গেরিলা যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং শত্রুপক্ষের সরঞ্জাম ও সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে।

মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠাঃ বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং মুক্তাঞ্চল গঠন করে, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। এই মুক্তাঞ্চলগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে এবং সেখান থেকে তারা আক্রমণের পরিকল্পনা করে।

প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ঃ ভারতীয় সরকারের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে ওঠে।

তৃতীয় ধাপঃ সম্মুখ যুদ্ধ ও বিজয় (সেপ্টেম্বর - ডিসেম্বর)

সম্মুখ যুদ্ধঃ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যৌথ বাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করতে শুরু করে।

নভেম্বর - ডিসেম্বরঃ চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয়, যার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর পতন ত্বরান্বিত হয়। বিশেষ করে, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।

বিজয়ঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই দিনটি বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

এই তিনটি ধাপের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে সমাপ্ত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৯৭১ ‍সালে বিজয়ের তৎকালিন উৎযাপন

১৯৭১ সালে বিজয়ের তাৎক্ষণিক উদযাপন ছিল বাঙালি জাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করল, তখন ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে লোকজন রাস্তায় নেমে আনন্দ-উল্লাস করতে থাকে। এই সময়ের কিছু বিশেষ দিক:

১. আনন্দ মিছিলঃ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয় মিছিল করে। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, নানা স্লোগান দিয়ে তারা বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করে।

২. গান ও নৃত্যঃ অনেক স্থানে লোকজন গান গেয়ে এবং নাচের মাধ্যমে বিজয় উদযাপন করে। দেশাত্মবোধক গানগুলো বিশেষ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

৩. আতশবাজি ও আলোকসজ্জাঃ ঢাকা শহর এবং অন্যান্য প্রধান শহরগুলোতে আতশবাজি ফোটানো হয় এবং আলোকসজ্জা করা হয়।

৪. মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনাঃ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাদের সাহসিকতা এবং ত্যাগের জন্য বিশেষ সম্মান জানানো হয়।

৫. ধর্মীয় অনুষ্ঠানঃ অনেকেই বিজয় দিবসে মসজিদ, মন্দির, এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থানে গিয়ে বিশেষ প্রার্থনা করেন এবং জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করেন।

৬. প্রেস এবং রেডিওঃ সেই সময়ে সংবাদ মাধ্যমগুলি, বিশেষ করে রেডিও, একটানা বিজয়ের খবর প্রচার করে। রেডিওতে বাজানো দেশাত্মবোধক গান এবং বিশেষ অনুষ্ঠানগুলি মানুষের মধ্যে উল্লাস ও উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয়।

বিজয়ের এই প্রথম উদযাপন ছিল বাঙালি জাতির জন্য এক নতুন স্বপ্নের সূচনা, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে বাঁচার এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ পায়।

বর্তমানে সেই বিজয় উৎযাপন

১৯৭১ সালের বিজয় উদযাপন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের শেষে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। 

বিজয়ের দিন বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্নভাবে আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত, বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের সকল সরকারি, বেসরকারি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা উত্তোলন করা হয়, বিজয়ের স্মরণে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো হয়। 

এছাড়া, অনেক জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান, নৃত্য ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। বিজয় দিবসের এই উৎসব বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি একটি বড় ধরনের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগ।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url